“আমি জিপিএ-৫ পেতে চাই, আমার নাম শামসুদ্দীন”—মাজারের দেয়ালে খোদাই করা এই বাক্যটি কেবল একটি ব্যক্তির নয়, বরং বিগত শত বছরের, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের স্মারকবাক্য। কয়েক কদম এগোলেই চোখে পড়ে, “এসএসসি পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে চাই”, কিংবা “নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করতে চাই”—এমন শত শত লেখা, যা শুধু একটি দেয়াল নয়, বরং হাজারো শিক্ষার্থীর ফরিয়াদের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চট্টগ্রামের অঞ্চলভিত্তিক একটি সুফি দরগাহ— মোল্লা মিসকিন শাহ (রহ.)’র মাজার; বছরের পর বছর ধরে আশেপাশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক আত্মিক আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল, চাকরির প্রস্তুতি, কিংবা মানসিক শান্তি; সব কিছুরই নিরব সাক্ষী হয়ে উঠেছে এই মাজার।
প্রতি বছর এসএসসি, এইচএসসি কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের এক বিশাল অংশ এখানে দোয়া করতে আসে। কেউ কেউ পরীক্ষার দিন সকালে এসে মাজারের দেয়ালে হাত রেখে প্রার্থনা করে। এই প্রবণতা শুধু আবেগ নয়, বরং একটি বিস্তৃত সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিযোগিতামূলক রূপ, পরীক্ষার চাপ ও সাফল্যের অসম সুযোগবণ্টন শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিয়েছে এক আধ্যাত্মিক আশ্রয়ের দিকে।
প্রাথমিক পরিচয়
হামিদুল্লাহ খানের ফারসি ভাষায় রচিত ‘আহাদিস আল-খাওয়ানিন’ শীর্ষক ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই দরবেশের উত্তরাধিকারীরা চট্টগ্রামের রাউজান থানার অন্তর্গত কদলপুর গ্রামে বাস করতেন। কিন্তু মাজারের একজন খাদেম হারুন, যিনি সুদীর্ঘ প্রায় ৪ দশক এখানে কর্মরত, তার মতে, মিসকিন শাহ মূলত বাগদাদ থেকে এ অঞ্চলে আগমন করেছেন। এ ব্যাপারে ডা. আবদুল করিম প্রদত্ত তথ্যের সামঞ্জস্যতা রয়েছে। মোল্লা মিসকিন শাহ (রহ.) এর সাথে আরও কিছু সুফির আগমন ঘটে, যেমন: বন্দে রিজা শাহ, শাহ মুবারক আলী, কাবুলী শাহ, শাহ নূর। তাদের কবরও মিসকিন শাহ (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গণে রয়েছে। (করিম: ১৯৮৭, ৭)
হামিদ উল্লাহ খান বলেছেন যে, মোল্লা মিসকিন শাহ মুগল আমলে যেই লাখেরাজ সম্পত্তি লাভ করেন তা কদলপুর এবং আঁধার মানিকে অবস্থিত ছিল। কদলপুর ও আঁধার মানিক দুইটি গ্রাম, এগুলো বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলায় অবস্থিত।
মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের একটি ফরমানে উল্লেখ রয়েছে যে, সম্রাট সুবাহ বাংলার ইসলামাবাদ সরকারের অন্তর্গত হাভেলী চট্টগ্রাম পরগণায় বিশ বিঘা জমি মোল্লা মিসকিনকে জীবিকা ভাতা (‘মদদ-ই-মা‘আশ’) হিসেবে মঞ্জুর করেন। ১১০৩ হিজরিতে (১৬৯১-৯২ খ্রি.) জারিকৃত এই আদেশে মোল্লা মিসকিনের পিতার নাম সিপাহ্দু এবং পিতামহের নাম শেখ সারদু মুগলী সিদ্দিকী উল্লেখ করা হয়েছে। (পূর্বোক্ত) খেদমতগার হারুনের মতে, মোল্লা মিসকিন শাহ’র মাতার নাম শেখ সাঈদু মুগলী।
কাল নির্ণয়
ড. এনামুল হক বলেন, বদর শাহ ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন, অর্থাৎ চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জীবিত ছিলেন। মোল্লা মিসকিন বদর শাহের কয়েক বৎসর পরে চট্টগ্রামে আসেন। (হক: ১৯৯৫, ২৫৭)
কিন্তু সম্প্রতি আবিষ্কৃত হওয়া একটি দলিল, যা মোল্লা মিসকিন শাহকে কেন্দ্র করে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের একটি ফরমান। এটি চট্টগ্রাম কালেক্টরেটে অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। ভঙ্গুর অবস্থা থেকে যতটুকু পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে তা এরকম: “এটি ছিল একটি সেরা মুহূর্ত এবং সুবে বাংলার চট্টগ্রামে অনাবাদি ভূমি দেখাশোনার জন্য তাঁর রাজকীয় এই ফরমান জারি হয়েছিল। হাভেলি চাটগাম
পরগনাকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য মদদ-ই-মাস এবং সহায়তাকারী হিসেবে হাজি মিসকিনের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সেই ভূমিগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ সালতানাতের দৈনন্দিন সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্বের জন্য ব্যয় করা হবে (এবং তাঁর [মোল্লা মিসকিনের] প্রার্থিত দোয়া এই লক্ষ্যের পথকে মসৃণ করবে)। (একইভাবে) বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হাকিম, আমিল, জাগিরদার, কোরোরিস প্রত্যেকে তাদের নিজেদের জমি খড়ি দ্বারা অঙ্কিত
করবেন এবং নিবন্ধনের জন্য মোল্লা মিসকিনের শরণাপন্ন হবেন এবং (এই
আদেশের বাইরে) এর সাথে সাংঘর্ষিক সবকিছু রহিত হলো।” (হুদা, ২০১৯, ৯৬)
ফরমানটি থেকে স্পষ্ট যে, চট্টগ্রামের তৎকালীন যত হাকিম, আমিল, জাগিরদার, কোরোরিস প্রত্যেককে আওরঙ্গজেবের দফতর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল মোল্লা মিসকিন শাহ’র শরণাপন্ন হয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করার জন্য। নিশ্চয়ই তিনি তখন জীবিত ছিলেন। অর্থাৎ, আওরঙ্গজেবের শাসনামল— ১৬৭৯ থেকে ১৭০৭ খ্রি.— এই সময়ের মধ্যে মিসকিন শাহ চট্টগ্রামে বসবাস করছিলেন।
মিসকিন শাহ’র আগমনকাল নিয়ে ডক্টর এনামুল হকের যে দাবি— ‘চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জীবিত ছিলেন, বদর শাহের কয়েক বৎসর পরে চট্টগ্রামে আসেন’— তা আওরঙ্গজেব কর্তৃক জারিত ফরমান অনুযায়ী নাকচ করা যায়। পাশাপাশি তাঁর মাজার সংলগ্ন শাহী মসজিদ যে প্রাক-মুগল নয়, বরং নির্মাণরীতি ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে মুগল আমলের এ ব্যাপারে অভিমত দিয়েছেন ডক্টর শেহাবুল হুদা। ধারণা করা যায়, মিসকিন শাহ জীবিতাবস্থায়ই উক্ত মসজিদ নির্মাণ করেন। কেননা, স্বয়ং আওরঙ্গজেব কর্তৃক ফরমানের মালিক মিসকিন শাহ’র দরবারে একটি মসজিদ থাকবে না তা কল্পনাও করা যায় না।
অন্যদিকে, খেদমতগার হারুনের মতে, মোল্লা মিসকিন শাহ’র অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে ১৮১৯ সালে। এর আগে চন্দনপুরার এই স্থানটিতে তার মাজারের সাথে লাগোয়া একটি মসজিদ ছিল, কিন্তু শায়িত ব্যক্তিটির পরিচয় সম্পর্কে মানুষ এতটা অবগত ছিল না।
মাজার প্রাঙ্গনটি মূলত সরকারী মোহসীন কলেজের (পূর্বতন চট্টগ্রাম মাদ্রাসা) বিপরীত দিকে পাহাড়ের উপর শাহী মসজিদের পাশে অবস্থিত। ড. এনামুল হক রোড (পূর্বতন কলেজ রোড) থেকে একটি সুউচ্চ সিঁড়িপথে সমাধিস্থলে পৌঁছানো যায়। স্থানীয় জনগণ একে মোল্লা মিসকিন বা মোল্লা সাইনের তাকিয়া (খানকাহ) নামে অভিহিত করে থাকেন।
ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামকে যে বারো আউলিয়ার দেশ বলে অভিহিত করা হয় সেই বারো আউলিয়ার একজন মোল্লা মিসকিন শাহ (রহ.)। সুফি সাধক মোল্লা মিসকিন শাহ চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় তাঁর নিজস্ব তকিয়ায় সাধনারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পরও তিনি কেবল একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ হিসেবে নয়, বরং চট্টগ্রামের নাগরিকদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গ হিসেবে বর্তমানেও ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক। নানান মানত, দুঃখ-কষ্টের নিরসন এবং বিশেষত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভিত্তিক ফরিয়াদে তিনি এক আশ্রয় ও ভরসার প্রতীক হয়ে আছেন।
শবে বরাত ও শবে ক্বদরে সারারাত ধরে মোল্লা তকিয়ায় অবস্থান করে ভক্তকুল। চকবাজার এলাকাটি চট্টগ্রামের কোচিং হাব হিসেবে সুপরিচিত, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী আগমন করে। এই এলাকায় অবস্থিত দুটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ ও দুটি পুরনো বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী হওয়ায়, মিসকিন শাহের মাজারটি উক্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থীদের নিকট একধরনের মানসিক প্রেরণা ও ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে।
একাডেমিক সফলতার পেছনে ধর্মীয় সহায়তা প্রার্থনার এই প্রবণতা ও সফলতা, মোল্লা মিসকিন শাহ ও তাঁর মাজারকে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের নিকট আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ-রূপে হাজির করেছে।
নির্দেশিত গ্রন্থাবলি:
১. মোল্লা মিসকিন শাহ (রঃ): ডা. আবদুল করিম, বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম, ১৯৮৭
২. মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড : মনসুর মুসা সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫
৩. চট্টগ্রামের সুফি সাধক ও দরগাহ : ড. মুহম্মদ শেহাবুল হুদা, শাহাব উদ্দিন নীপু কর্তৃক অনুদিত, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯