ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, শাহবাগ কিংবা তৎসংলগ্ন এলাকায় যারা বসবাস করেন, তারা জীবনে একবার হলেও আজিমপুরে গিয়েছেন অথবা অন্তত নামটুকু শুনেছেন। আজিমপুর কবরস্থানের পাশ ধরে ইরাকী মাঠ পার করে কিছুটা সামনে হেঁটে গেলেই লোকমুখে শোনা যায় ‘দায়রা শরিফ’। এটিই আড়াইশো বছরের পুরোনো সে আজিমপুর দায়রা শরিফ; এখানেই শায়িত আছেন শাহ সুফি সায়্যিদ দায়েম পাক রহ. এবং তার পরিবারবর্গ। চারশো বছরেরও অধিক পুরোনো একসময়কার বন-জঙ্গলে ঘেরা এই ঢাকাকে যারা আবাদ করেছেন, সায়্যিদ দায়েম পাক তাদের অন্যতম। আজিমপুর দায়রা দূর ঢাকায় হলেও চট্টগ্রামের সুফিদের সাথেও এর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হযরত আমানত শাহ এবং মাইজভান্ডার দরবার শরিফের বুজুর্গদের সাথে আজিমপুর দায়রার সিলসিলাগত সম্পর্ক রয়েছে।
সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ণয় করা দুষ্কর হলেও ধারণা করা হয়, অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকেই দায়েম পাকের জন্ম হয় ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার মধ্যবর্তী ধুম রেলস্টেশনের নিকটবর্তী খইয়ারা নামক স্থানে। (আব্দুল্লাহ : ১৯৯১, ২৮৮) ঢাকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হেকিম হাবিবুর রহমান দায়েম পাককে চট্টগ্রামের বারো আউলিয়ার অন্যতম শাহ সুফি বখতিয়ার মাহিসাওয়ার (রহ.)-এর বংশধর বলে উল্লেখ করেছেন; বাগদাদ থেকে মাছের পিঠে করে হালদা নদী হয়ে তার আগমন হয় চট্টগ্রামে। (রহমান : ১৯৪৬, ৯৭) বখতিয়ার মাহিসাওয়ার (রহ.)-এর দুজন পুত্র ছিল—সায়্যিদ মুহাম্মদ জাহাঁ শাহ ও সায়্যিদ মুহাম্মদ হায়া শাহ। দায়েম পাক ছিলেন সায়্যিদ হায়া শাহ-এর বংশধর। (আব্দুল্লাহ: প্রাগুক্ত)
কিশোর বয়সেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে সুফি দায়েম রহ. মনোনিবেশ করেন ইলমে হাদিস ও ইলমে ফিকহে ব্যুৎপত্তি অর্জনে। বাল্যকালেই তিনি হযরত আমানত শাহ’র কামালিয়্যাতের সুখ্যাতি শুনতে পান এবং কিছুকাল পরেই মারেফতের গূঢ় তত্ত্ব শেখার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। প্রসঙ্গত, হযরত আমানত শাহ রহ. ছিলেন ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের মিঞা সাহেব ময়দানস্থ খানকাহের শাহ আব্দুর রহীম শহীদের (মৃ. ১৭৪৫ খ্রি.) খলিফা। (আব্দুল্লাহ: প্রাগুক্ত, ২৮৯) আমানত শাহ রহ.-এর সাথে কিছুকাল অবস্থানের পর সুফি দায়েম পাক তার নিকট বায়আত গ্রহণ করেন এবং সুফি-সাধনায় উত্তরোত্তর উন্নতির মাধ্যমে খেলাফত লাভ করেন।
সুফি দায়েম তখন অল্পবয়স্ক; এমন অপরিণত বয়সে তার নিকট থেকে একটি কারামত প্রকাশ পেয়ে যায়। এতে আমানত শাহ রহ. কিছুটা অসন্তুষ্ট হন। অনুনয়-বিনয়ের দরুন প্রিয় শিষ্যকে ক্ষমাও করে দেন। ইলমে মারিফাতে আরও পরিপক্বতা লাভ করতে আমানত শাহ রহ. এবার তাকে স্বীয় মুর্শিদের স্থলাভিষিক্ত গদিনশিন শাহ নাজিমুদ্দীনের নিকট ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সুফি দায়েম এখানে আরও চার বছর অবস্থান করে মারিফতের উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। শাহ নাজিমুদ্দিন এবার সুফি দায়েমকে শাহ সুফি মুনয়িম পাকবাজ রহ.-এর নিকট প্রেরণ করেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে কামালিয়্যাত অর্জন করেন এবং নকশবন্দিয়া তরিকা আবুল উলাইয়্যাহ সিলসিলায় বায়আত করানোর অনুমতি লাভ করেন। এরপর শাহ সুফি মুনয়িম পাকবাজ রহ.-এর নির্দিশে তিনি গমন করেন পাটনায় শাহ নিয়ামতুল্লাহ রহ.-এর নিকট এবং তার সাহচর্যে দিক্ষীত হন। (কলেবর বৃদ্ধি না করার লক্ষ্যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া থেকে বিরত থাকা হলো।)
এভাবে বিভিন্ন সুফির নিকট হতে মারিফতের ফয়েজ লাভ করে পুনরায় ফিরে আসেন ঢাকায়। মিঞা বাজারস্থ খানকাহের পীর সাহেব শাহ নাজিমুদ্দিনের নির্দেশে সুফি দায়েম তার পূর্বেকার মুর্শিদ হযরত আমানত শাহ’র সাক্ষাতে চট্টগ্রাম আসেন। কিছুকাল অবস্থান শেষে মুর্শিদের অনুমতিক্রমে ঢাকায় ফিরে আসেন। অবশেষে, তাঁর তাসাওউফ-সফরের ইতি ঘটল; তিনি স্থায়ী হলেন ঢাকার আজিমপুরে। পরবর্তীতে শাহ নাজিমুদ্দিনের নির্দেশে ১৭৬৬ সালে এখানেই প্রতিষ্ঠা করেন আজিমপুর দায়রা শরিফ।
কথিত আছে, মোগল সুবাহদার আজীমুশশান এবং বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খানের ঢাকা ত্যাগের পর আজিমপুর এলাকাটি ক্রমান্বয়ে জঙ্গলে পরিণত হয়। শিয়াল আর বাঘও দেখা যেত সময়ে সময়ে। এমন বিপদসঙ্কুল ও নির্জন পরিবেশেই সুফি দায়েম রহ. ধ্যানমগ্ন থাকতেন। সময়ের সাথে সাথে তাঁর বুজুর্গির খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকজন তার সাহচর্য লাভের জন্য দায়রা শরীফে আসতে থাকে। সুফি দায়েম রহ. খানকাহের পাশেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তার শিষ্য মারী শাহ একবার কিছু শাক সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এ শাক দিয়েই তিনি প্রথমবার চালু করেন লঙ্গরখানা। গরিব-দুঃখী-অসহায় এবং মুসাফিরগণ লঙ্গরখানায় আহার গ্রহণ করতো। ইতিহাস পর্যালোচনাপূর্বক বলা যায়, আঠারো শতকের ষাট বা সত্তরের দশকেই তিনি আজিমপুরে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। (প্রাগুক্ত, ২৯০)
সুফি দায়েম পাক রহ. যেভাবে ছিলেন শরিয়তের পাবন্দ এবং তরিকতের অনুসারী, একইভাবে ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষায়ও ছিলেন যথেষ্ট অনুরাগী। তার সময়েই ইলমে শরিয়তের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে আজিমপুর খানকাতে আলিম-ফাজিল নিযুক্ত করা হয়। বহু শিক্ষার্থী খানকার মাদ্রাসায় পড়তে আসতো। খানকাহ থেকে বিনামূল্যে তাদের খোরপোশের ব্যবস্থা করা হতো। (রহমান, প্রাগুক্ত, ৯৮)
সুফি রওশন আলী রহ. ছিলেন দায়েম পাক রহ.-এর জামাতা, প্রধান খলিফা এবং দায়রা শরিফের প্রথম গদিনশিন। আনুমানিক ১২১৪ হিজরি মোতাবেক ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহ সুফি সায়্যিদ মুহাম্মদ দায়েম পাক রহ. ইন্তেকাল করেন। তখন তার দুই পুত্র শাহ সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ও শাহ সৈয়দ লাকিত উল্লাহ’র বয়স ছিল যথাক্রমে ১৪ বছর ও ৯ বছর। জামাতা সুফি রওশন আলী’র তত্ত্বাবধানে তারা বেড়ে ওঠেন; শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করেন এবং সুফি দায়িম পাক’র সিলসিলার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে ওঠেন। তাঁর দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ লাকিত উল্লাহ একজন অসাধারণ কামেল অলি ছিলেন। হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী ও তাঁর অন্যতম খলিফা রসুলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী- হযরত সৈয়দ লাকিত উল্লাহ’র সান্নিধ্যে যাওয়া–আসা করতেন। হযরত লাকিত উল্লাহ ১২৫৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।
শাহ সুফি দায়েম পাক (রহ.) প্রতিষ্ঠিত খানকাহ শরীফে পূর্ববর্তী বুজুর্গদের সংগৃহীত কিতাবাদির একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। এতে রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য আরবি, ফারসি ও উর্দু গ্রন্থের সমাহার; তন্মধ্যে শাহ ফজলে হক-এর ‘মুঝদা-এ-ফজল-এ-হক’ এবং শাহ খলীলুল্লাহর ‘আসবার-এ-খলীল’ উল্লেখযোগ্য। এই খানকাহ শরিফে সোনালি রঙের দুটি সুন্দর কুরআন শরিফ রয়েছে—একটিতে মুঘল বাদশাহ আলমগীরের আমল থেকে দ্বিতীয় শাহ আলমের আমল পর্যন্ত ঢাকার কাজিদের সীলমোহরের ছাপ রয়েছে। এটি কুরআনের একটি বিরল কপি। (আমীন : ১৯৯৬, ২২১)
আজিমপুর খানকাহ শরিফের দায়িত্বশীলগণ বর্তমানে শুধু আধ্যাত্মিক দীক্ষাই নয়, বরং আধুনিক শিক্ষায়ও শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন চাকুরিতে নিয়োজিত আছেন। ছোট দায়রার গদিনশিনগণও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। সুফি দায়িমুল্লাহ একজন ভালো ইউনানি চিকিৎসকও বটে। তিনি ‘দায়িমী হেলথ কমপ্লেক্স’ নামে একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। কয়েকটি জেলায় এই দাওয়াখানার অনুমোদিত এজেন্টও রয়েছে। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা স্থাপন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার আমিরাবাদ সুফিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, সুফিয়া দায়িমীয়া মুসলিম এতিমখানা ও কুমিল্লার আস্মতুল্লাহ এতিমখানা উল্লেখযোগ্য। (আমীন : প্রাগুক্ত, ২২১)
দায়রা শরিফ সংশ্লিষ্ট কবরস্থানে রয়েছে ঢাকার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের কবর। তন্মধ্যে হেকিম হাবিবুর রহমানের কবরটি উল্লেখযোগ্য। শবে বরাত ও শবে কদরের রাতে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা কবরস্থানটি জেয়ারত করতে আসেন।
সুলতানি, মুঘল, নবাবি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের পর এই ঢাকা শহর ৪০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশেল বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা—‘পুরান ঢাকা’। আর এই পুরান ঢাকার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হিসেবে আড়াইশো বছরের ঢাকার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজিমপুর দায়রা শরিফ।
গ্রন্থপঞ্জি:
১. ঢাকার কয়েকজন মুসলিম সুধী : ড. মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, জুন ১৯৯১
২. আসুদেগান-এ-ঢাকা : হাকীম হাবীবুর রহমান, ঢাকা, ১৯৪৬
৩. আজিমপুর দায়রা শরীফ : শাহ সূফী সাইয়্যেদ আহ্মাদুল্লাহ্, আজিমপুর দায়রা শরীফ খানকাহ, ২০১২
৪. বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সূফীদের অবদান (১৭৫৭—১৮৫৭) : মুহাম্মদ রুহুল আমীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রির জন্য প্রস্তুত অভিসন্দর্ভ, ১৯৯৬