বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র চট্টগ্রাম। বন্দরের কারণে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে আরব বণিকরা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলায় ইসলাম প্রচারের একক নেতৃত্ব দিয়েছেন সুফি-সমাজ। আর চট্টগ্রাম সুফি ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। এখানে আগত সুফি সাধকেরা পাহাড়, নদী ও জনপদের মাঝে স্থাপন করেছিলেন খানকাহ, মসজিদ ও দরগাহ; যা আজও স্থানীয় জনগণের আধ্যাত্মিক অনুরাগ ও শ্রদ্ধার কেন্দ্র।
মুসলমানরা সর্বকালে সকল দেশে ইতিহাস সচেতন জাতিরূপে সুপরিচিত, ভারত উপমহাদেশে মুসলমানেরাই ইতিহাস রচনার ব্যাপারে পথিকৃৎ। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। যে সকল সুফি সাধকদের প্রচেষ্টায় এই দেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে, তাঁদের সম্বন্ধেও বেশি কিছু জানা যায় না। এখন আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে ইতিহাস-সচেতনতা বাড়ছে এবং মানুষ ইতিহাস রচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম যে বার-আউলিয়ার নামে পরিচিত, সেই বারজন আউলিয়ার ইতিহাসও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। একমাত্র শাহ মোহসেন আউলিয়া সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, যা ধীরে ধীরে পাঠের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
চট্টগ্রামের বারো আউলিয়ায় শাহ মোহসেন আউলিয়ার (শাহ মছনদ আউলিয়া) অন্তর্ভুক্তির প্রমাণ:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে একটি আরবি পাণ্ডুলিপি সংগৃহীত হযে়ছে, পাণ্ডুলিপীর কোন নাম বা তারিখ নেই। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে নবাব সিরাজ উদদৌলার পরে আর কারো নাম পাওয়া যায় না। অনুমান করা যায় যে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অব্যবহিত পরে এই পুস্তিকাখানি লিখা হয়। এই পুস্তিকায় পীর দরবেশদের কয়েকটি তালিকা পাওয়া যায়, যেমন:
(১) দওয়াজদান আউলিয়া বা বার আউলিয়া,
(২) পীর পঞ্চ বা পাঁচ পীর,
(৩) চেহেল অবদাল বা চলি্লশজন আবদাল,
(৪) জুমলা আউলিয়া বা সকল সুফি, এবং চাহার পীর বা চারিজন পীর।
এই তালিকায় আরো আছে পয়গম্বরদের নাম, সাহাবিদের নাম, রসূলুল্লাহ’র বংশ তালিকা, ইমামদের নাম, মোগল সম্রাটদের নাম, এবং বাংলায় সুবাদারদের নামের তালিকা।
উল্লেখ্য যে, ঐ পীর দরবেশদের তালিকায় চেহেল আবদাল বা ৪০ জন আবদালের নামের ক্রমে শাহ কত্তল করম উদ-দীন, হাজী খলীল পীর, শাহ বদর আলম এর সাথে ৭ নং-এ শাহ মছনদ তথা শাহ মোহসেন আউলিয়ার নামটি পাওয়া যায়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, বারো আউলিয়া নিতান্তই স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট ধারণা। ধারণাটি সম্ভবত ঢাকা-ট্রাংক রোডের কুমিরায় অবস্থিত বারো আউলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে।
ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম-সোনারগাঁ-সিলেটে অনেক ফকিরের আনাগোনা দেখলেও চট্টগ্রামের বারো আউলিয়ার নাম দেননি। বারো আউলিয়ায় বারো জন পীরের পরিচিতি পাওয়া না গেলেও তিনজন পীর সম্পর্কে অকাট্য এবং প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়, উনারা হলেন কত্তাল শাহ, বদর শাহ এবং মোহসেন আউলিয়া। (করিম, ২০২৩, ৩০-১)
সময় নির্ধারণ:
ডা. আবদুল করিম, বারো আউলিয়ার চট্টগ্রাম আগমনের সম্ভাব্য সময় নিরূপণ করেছেন চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তথা সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের চট্টগ্রামের বিজয়কে কেন্দ্র করে। তাঁর মতে, শাহ মোহসেন আউলিয়া চট্টগ্রামের বর্তমানে আনোয়ারা থানার ঝিউরি গ্রামে চতুর্দশ পাদের কোনো এক সময়ে সমাহিত হন। তাঁর সম্মানে সুলতান আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
মাজার স্থানান্তর:
মাজার এবং মসজিদ উভয়ই নদী ভাঙনের কবলে পতিত হলে শাহ মোহসেন আউলিয়ার কফিন বটতলী গ্রামে স্থানান্তরিত হয়, কিন্তু ভাঙ্গা মসজিদ আর স্থানান্তর করা সম্ভব ছিল না, শুধু শিলালিপিটি নতুন মাজারে নিয়ে এসে সংরক্ষণ করা হয়। শাহ মোহসেন আউলিয়ার ইন্তেকালের সময় চট্টগ্রাম আরাকানের মগ রাজার অধীনে ছিল, কিন্তু হোসেন শাহী আমলে চট্টগ্রাম পুনরায় বিজিত হলে মুসলিম সুলতান মাজারের নিকটে মসজিদটি নির্মাণ করেন, শিলালিপিটি সেই মসজিদেরই অংশ বিশেষ। (প্রাগুক্ত, ৩৯)
শিলালিপি ও সনদ থেকে প্রামাণ্যতা:
ডা. এনামুল হক A History of Sufi-Ism in Bengal গ্রন্থে ঐ শিলালিপিটির পাঠ দিয়েছেন। শিলালিপি নিয়ে ডা. হকের মন্তব্য:
“বেশ খানিকটা চেষ্টা ও কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের পর আমরা জানতে পারি যে, এটি তুঘরা অক্ষরে লেখা একটি পারসি শিলালিপি। বর্তমানে এর অবস্থা খুব ভালো নয়। লেখার অর্ধেক অংশ ইতোমধ্যে মুছে গেছে। আমরা এই শিলালিপীর তিনটি ছাপ সংগ্রহ করি এবং পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনি। পরে ভারতীয় জাদুঘরের বিশেষজ্ঞ মি. শামসুদ্দিনের সহায়তায় আমরা নিচের লেখাটি পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হই:
প্রথম লাইন: بتاريخ بستم ماه شوال عابد مجذوب
দ্বিতীয় লাইন: পড়ার অযোগ্য।
তৃতীয় লাইন: XXX
অর্থ: বিশ শাওয়াল তারিখে আবিদ ও মজজুব XXX (অনুপূরিত অংশ) ৮০০ হিজরি বা ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দ।
যতটুকু পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে তা থেকে সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, হজরত মোহসেন আউলিয়া ৮০০ হিজরী মোতাবেক ১৩৯৭ সালে ইন্তেকাল করেন।” (Haque, 1975, 254)
যদিও ডা. করিমের মতে, ডা. হকের প্রথম চারটি শব্দ ছাড়া বাকি পাঠ গ্রহণযোগ্য নয়।
শায়েস্তা খানের ছেলে বুজুর্গ উমেদ খানকে সেনাপতি নিয়োগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিজয় করেন। বুজুর্গ উমেদ খান শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাবার পর মোহসেন আউলিয়ার তিনজন অধস্তন পুরুষকে একটি সনদ দিয়ে দশ দ্রোণ লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেন।
সনদটি চট্টগ্রাম জেলা কাছারিতে সংরক্ষিত আছে, তবে অনেক প্রাচীন হওয়ায় কাগজ ভঙ্গুর হওয়ায় এর ফটোকপি করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় সনদের হাতের লেখা কপি সংগ্রহ করা হয়েছে। হাতের লেখাও প্রাচীন, এর সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধারও কঠিন ব্যাপার।
তবে মোটামুটিভাবে সনদের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা সম্ভব। সনদ এবং সনদ পরবর্তী রোবকারি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সনদটি মৌলিক এবং এর মধ্যে কৃত্রিমতা নাই। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই সূত্রটি সর্বাপেক্ষা মূল্যবান; প্রথম সূত্র শিলালিপীর তারিখ জানতে না পারায় শিলালিপীর গুরুত্ব কিছুটা খর্ব হয়েছে, কিন্তু এই সনদটির তারিখও আছে, যিনি দান করেছেন তাঁর নামও আছে, যাদের অনুকূলে দেওয়া হয়েছে তাদের নামও আছে, কি উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে এবং সর্বাপেক্ষা মূল্যবান হচ্ছে, এই সনদটি যাঁর সম্মানে দান করা হয়েছে তার নামও আছে। (করিম, প্রাগুক্ত, ৪০)
আগমনের ঘটনা:
পীর বদর, কত্তল পীর এবং শাহ মোহসেন আউলিয়া প্রথমে পানিপথ থেকে গৌড়ে আসেন। কিন্তু সেখানে তারা বসবাস করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, তাই গৌড় ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং সেখানে তারা কিছু সময় অবস্থান করেন। পরে তাঁরা জলপথে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন। ভেসে চলার জন্য তাঁরা তিন ধরনের বাহন ব্যবহার করেন—একজন কাঠের তক্তা, আরেকজন কাতলা মাছ এবং শাহ মোহসেন আউলিয়া একটি বড় পাথরের খণ্ড ব্যবহার করেন। দীর্ঘ যাত্রার পর শাহ মোহসেন আউলিয়া চট্টগ্রামের ঝিয়রী গ্রামে পৌঁছেন, সেখানে বসবাস শুরু করেন এবং ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। (Haque, 1975, 253)
জনশ্রুতি, ঘটনাবলী ও গুরুত্ব:
কিংবদন্তিতে প্রকাশ পায়, শত বৎসর পূর্বে শাহ মোহসেন আউলিয়ার মামা হজরত বদর আউলিয়া রহ.-কে নিয়ে তিনি দিল্লিতে পদার্পণ করেন। কথিত আছে, তিনি একটি পাথরকে বাহন বানিয়ে সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে এসেছিলেন।
সেখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা হয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিওরী গ্রামের শংখ নদীর তীরে আস্তানা স্থাপন করেন।
মাজারের সংস্কার তথ্য:
মাজার শরীফ অনেক পূর্বে নির্মিত হয়েছে বিধায় সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। তাই বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত মোতোয়াল্লী এস এম ফজলুল করিম তৎপুত্র এস এম ইলিয়াছ করিম, জহির উদ্দীন মাস্টার এবং অন্যান্য ওয়ারিশ ও খাদেমগণের বিশেষ অনুরোধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম, আলহাজ্ব হোছনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় এবং নিজস্ব অর্থায়নে নতুন আঙ্গিকে, নতুন পরিকল্পনায় আরো বৃহদাকারে মাজার শরীফ পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
শেষ কথা:
দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজার শরীফে আসেন। প্রত্যেক বছর আষাঢ় মাসের ৬ তারিখ হযরত শাহ মোহসেন আউলিয়ার ওরস অনুষ্ঠিত হয়। মাজারকে কেন্দ্র করে বটতলীতে তৈরি হয়েছে একটি আলাদা ধর্মীয়-সামাজিক পরিবেশ। প্রতি বছর ওরসের সময় হাজারো মানুষ এখানে এসে সমবেত হয়। এতে করে স্থানীয় অর্থনীতি যেমন চাঙা হয়, তেমনি মানুষের মধ্যে মিল-মহব্বত, সহমর্মিতা ও বিশ্বাসের এক আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলার সুফি সমাজ ও বারো আউলিয়া: আবদুল করিম, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০২৩
২. A History of Sufi-Ism in Bengal : Dr. Enamul Haque, Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka, 1975